মরেও শান্তি ছিল না যে বেচারাদের...
আমি তখন ক্লাস টু শেষ করে থ্রি তে উঠি। সেবার বাৎসরিক যে ম্যাগাজিন ছিল সেটায় একটা আর্টিকেল ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। মিশরীয় কোন সমাধি খুঁড়ে কোন আর্কিওলজিস্ট মমির অভিশাপের সম্মুখীন হয় এরকম একটা আর্টিকেল। আর্টিকেলের শেষে জানতে পারি যে এরকম একটা মমি কিনে এক লোক একটা বিখ্যাত জাহাজে করে আমেরিকা যাওয়ার পথে জাহাজ ডুবে মারা যায়। প্লট টুইস্ট হিসাবে এইটাও জানি যে জাহাজের নাম ‘টাইটানিক’! এরপর তো আমার রাতের ঘুম হারাম। মমির অভিশাপ না জানি কত শক্তিশালী! তবে মজার ব্যাপার হলো একটা সময়ে এই মমিরা নিজেদের রাতের ঘুমও হারাম হয়ে গেসিল। আর এই ঘুম হারামের কারণ হচ্ছে ক্যানিবালিজম!
Mummyfication বা মৃত্যুর পর মমি বানানোর যে প্রসেসটা, সেটা শুধু ফারাও আর অভিজাতদের বেলায় হতো বলে অনেকের ধারণা। তবে ব্যাপারটা সত্য না। মমি বানানোর কারণটা আধ্যাত্মিক - একজন মানুষ মারা গেছে, দেবতা ওসাইরিসের দরবারে তার ডাক পড়বে সহস্র বছর পরে, তাই লাশ যেন ততদিনে পঁচে না যায় সেজন্যই মমিকরণ। তো বলা যায় যে, সামর্থ্য থাকলেই মিশরীয়রা মারা যাওয়ার পর মমি করতো। হয়তো হীরা-জহরত দিয়ে কফিন বানাতো না, সমাধিটাও পিরামিডের মতো বিশাল কিছু হতো না তবে লাশ যেন ওসাইরিসের সামনে পুনরোত্থান পর্যন্ত টিকে থাকে সে ব্যবস্থা করা হতো।
১৫ শতকের দিকে ইউরোপীয় ডাক্তারদের মনে আশ্চর্য খেয়াল জাগে। তখন অবশ্য রেনেসাঁর যুগ, সবার মনেই আশ্চর্য খেয়াল ছিল। তবে ডাক্তাররা ব্যাপারটা একটু অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাদের মাথায় আসে যে - যেহেতু মমিরা এত বছর ধরে টিকে আছে, সেহেতু নিশ্চয়ই তাদের উপর কোন জাদুকরী চিকিৎসাবিদ্যা প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন কথা হলো, জাদুকরী চিকিৎসাবিদ্যা মমির শরীর থেকে ট্রান্সফার করে সাধারণ রোগীদের উপর কীভাবে আনা যায়? ঠিক ধরেছেন - মমি খাওয়া সম্ভব। ব্যাপারটা শুনে গা গুলিয়ে আসতে পারে, তবে ইউরোপে আরো আগে থেকেই মৃতদেহ কনজিউম করার প্রথা ছিল, সে হিসাবে মমি খাওয়া তেমন অবাক করার মতো না। তাছাড়া আলকেমিশাস্ত্রও সে সময় বেশ উন্নতি করছিল - তাই অমরত্বের সন্ধানে মানুষ অনেক অভাবনীয় ব্যাপারও স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতো।
যাই হোক, মমি দিয়ে প্রস্তুত করা হলো সর্বরোগের মহৌষধ মামিয়া। জেলির মতো আঠালো এই বস্তুর প্রধান উপাদান ছিল ইজিপশিয়ান মমি, আর এর প্রধান ক্রেতা ছিল ইউরোপীয়রা। তবে সবাই যে মামিয়া খেত তা না। কেউ কেউ মমি নিয়ে নিজের মতো রান্না করে খেতে পছন্দ করতো। তারা মিশর থেকে আস্ত মমি-ই কিনে আনতো। মমি খাওয়া স্ট্যাটাস মেইনটেইন করার একটা উপায় হয়ে দাঁড়ালো। এখন যেমন কার আইফোনের মডেল কতো নতুন সেটা নিয়ে ফ্লেক্স করা যায়, তখনকার সময়ে কার ডিনারের মমি সবচেয়ে পুরান ছিল সেটা নিয়ে ফ্লেক্স করা যেত। মিশরের রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি হতে লাগলো মমিকৃত মৃতদেহ।
তবে এই সুখকর মৃতভক্ষণের ব্যাপারটা বেশিদিন চললো না। কারণ মমির স্টক তো সীমিত। ইজিপশিয়ানরা এই কাজ হাজার বছর আগেই ছেড়ে দিসে। মমির পরিমাণ দিন দিন কমতে লাগলো। বাজারে আসলো ভেজাল মমি - নকল না ঠিক, তবে অরিজিনাল মমিকরণ প্রসিডিউর মেনে বানানো হতো না। আর ওই মমিগুলার বয়সও কম, তাই সবাই পছন্দ-ও করতো না। গরীবেরা ভেজাল মমি কিনতো কারণ কিছু করার নাই। বড়লোকেরা কাঁড়িকাঁড়ি টাকা ঢেলে পুরান মমি কিনতো।
১৫৭১ এ অটোমান আর হলি লীগের এক নৌযুদ্ধে অটোমানরা বাজেভাবে হেরে যায়। এরপর গুজব রটে যে অটোমানদের হারার কারণ হচ্ছে তাদের জাহাজে মমি ছিল, সমাধি থেকে বের করায় ওই মমি তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছে। এরকম বেশ কিছু গুজব এরপর রটতে থাকে (বোধ করি টাইটানিকের ঘটনাটা-ও তেমন)। ১৬ শতকের মাঝে দিয়ে অটোমানরা সিদ্ধান্ত নেয় যে আর এইসব ক্যানিবালিজম চলতে দেয়া যাবে না। ওরা মমি ট্রেডিং-এ করা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা যদিও বেশ বিশাল আকারের মমি কালোবাজারির জন্ম দেয়, তবে মমির দামও বাড়তে থাকে। এই দাম বাড়া আর গুজব মিলিয়ে মমির চাহিদা অনেক কমে আসে।
১৮ শতকের দিকে মমি খাওয়া বন্ধ-ই হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় unwrapping party এর। এখন যেমন ইউটিউবাররা গিফট পেলে আনবক্সিং ভিডিও বানায়, তখন ইউরোপীয় ধনীরা তাদের বাসায় মমি আনবক্সিং করতো। দেখা যেতো রাতের বেলায় পার্টিতে হোস্ট তার স্টোররুম থেকে বিশাল এক লাশ নিয়ে আসছে। এরপর সবাই চারদিকে গোল হয়ে দেখতেছে ব্যান্ডেজ সরালে কী বের হয় (স্পয়লার: ব্যান্ডেজের ভেতর থাকতো হাজার বছর আগে মারা যাওয়া কোন মিশরীয়)। ধীরে ধীরে ওই ব্যাপারটাও শেষ হলো - এক বডি আর কয়বার আনভেইল করবে, ঠিক না?
কয়েক শতাব্দীজুড়ে ওষুধ, রান্না আর আনবক্সিং পার্টিতে ব্যবহৃত মমির শেষ ঠিকানা হলো যাদুঘরে আর অ্যাকাডেমিয়ায় - আর ব্ল্যাক মার্কেটে। মরেও শান্তি নাই বেচারাদের!