চীফ হিট অফিসার, বিদ্যানন্দ এবং অন্যান্য

আমার বন্ধু পলাশ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ে। মার্কেটিং মেজর বোধহয়। খুবই মেধাবী ছাত্র - বিজনেস কেইস কম্পিটিশনগুলায় সবসময় টপ থ্রিতে থাকে। তার সবই ভালো, শুধু একটাই সমস্যা - যখনই তাকে রচনা লিখতে দেয়া হয় সে সবার শেষে লিখে “সরকারের উচিত জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা।” বাংলা কোর্সে ‘বাবা’ সংক্রান্ত প্রবন্ধে সবাই যেখানে নিজের বাবার কথা লিখলো, সে লিখেছে, “কেউ যেন বাবা না কিনে আর দেশে যেন বাবা না ঢুকে এজন্য সরকারের উচিত গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।”

যাই হোক, পলাশ কয়দিন আগে গ্রামে গেছে। গ্রীষ্মকালে দুনিয়ে উল্টায় গেলেও সে গ্রামে যাবেই। এর কারণ হচ্ছে তার বাবার কাঁঠাল বাগান আছে। সে কাঁঠালের লোভে গ্রামে যায়। কিছু কাঁঠাল খায় আর বাকি কাঁঠাল অনলাইনে তার পেজ থেকে বন্ধুবান্ধবদেরকে দিয়ে জোর করে কেনায়।

একদিন সকালে প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখা গেল যে তার বাবা কিছু লোককে গালমন্দ করছে। ঘটনা জানতে পলাশ গেল সেখানে। জানা গেল যে পৌরসভা থেকে তাদের কাঁঠালবাগান কেটে ফেলা হবে? আংকেল মারাত্মক রেগে আছেন, “কাঁঠাল গাছ কেন কাটা হবে? ফাইজলামি নাকি?”

“কিছু করার নাই। রাস্তা বানাতে হবে। আপনাকে জমির টাকা দিব তো।” আংকেল টাকা নিয়ে আগ্রহ দেখালেন না। জিজ্ঞেস করলেন রাস্তা লাগবে কেন? গ্রামের মধ্য দিয়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। তাকে বলা হলো যে খালের উপর কালভার্ট বানানো হবে, সেটায় উঠার জন্য রাস্তা দরকার। খালের কথা শুনে সবাই অবাক হলো। মশার উপদ্রবের কথা বলে খাল ভরাট করা হয়েছে, এক বছর হতে চললো।

জানানো হলো যে খালা ভরাট করার পর দেখা গেছে আরেক এলাকায় ক্ষেতে পানি দেয়ার ব্যবস্থা নাই। যেহেতু ব্যবস্থা নাই সেহেতু আবার খাল খনন করা হচ্ছে। যেহেতু খাল খনন করা হচ্ছে সেহেতু খালের উপরে একটা ব্রিজ বানানো হবে। আর ব্রিজের জন্য রাস্তা লাগবে।

আংকেল অনমনীয়। “রাস্তা লাগলে বাগানের পাশ দিয়া বানান। গাছ কাটা লাগবো কেন? এই কাঁঠালবাগান আমার কত কিছু। কাঁঠাল বেইচা কত কিছু করলাম। বাসার ছাগলটারে পালি কাঁঠালের পাতা খাওয়াইয়া।” কথাটা শুনে পলাশ প্রথমে খুব লজ্জা পেল। এরপর খেয়াল করলো যে বাসায় একটা ছাগল আছে। যাই হোক কারো কোন আপত্তি ধোপে টিকলো না। জানানো হলো যে রাতেই গাছ কাটা হবে। কেননা হাতে মাত্র ছয় মাস সময়। এর মধ্যে সব করা লাগবে। ছয় মাস পর নির্বাচনের আগে দিয়ে সংসদ সদস্য এসে খালসহ কালভার্ট উদ্বোধন করবেন।

নির্বাচনের কথা শুনে আংকেল শক্তমতো একটা গালি দিয়ে বললেন, “গত দুই টার্মে তো নির্বাচনই হইলো না মিয়া। আবার কালভার্টের কী দরকার?”

এবার পৌরসভার লোক ক্ষেপে গেলেন। পলাশের বাবাকে পুলিশের ভয় দেখানো হলো। তারপর বাগানের জন্য কত টাকা আর কাঠ বেচে কত পাবেন এইসব হিসাব নিকাশ করে শেষ পর্যন্ত উনি বাগান ছেড়ে দিতে রাজি হলেন।

বেঁকে বসলো আমার বন্ধু পলাশ। এত প্রিয় কাঁঠালবাগান আজকে রাতে নাই হয়ে যাবে সে মেনে নিতে পারলো না। সে ঘরে পায়চারি করতে লাগলো, আর ঢাকার বন্ধুবান্ধবকে ফোন দিতে লাগলো। রাত হতে হতে বেশ কয়েকজন পলিটিকালি এক্টিভ বন্ধুবান্ধবে বাসা ভর্তি হয়ে গেল। ঠিক হলো রাতেই একটা ব্যবস্থা করা হবে। আংকেলকে আশ্বাস দিয়ে ঘুমাতে পাঠানো হলো। কিন্তু উনার তো ঘুম হয় না।

সকালে ঘুম ভাঙতেই দৌঁড়ে গেলেন বাগানে। দেখেন বাগান নাই। সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তবে প্রতিটা কাটা গাছের পাশে “গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান”, “বাঁচলে গাছ, নিবেন নিশ্বাস” এসব লিখা সাইনবোর্ড। কয়েকটায় আবার সুন্দর করে গাছের নিচে বাচ্চারা খেলার ছবি আঁকা।

“এসব কী?”

“জনসচেতনতার জন্য আব্বা।”

“সারারাত এইগুলা করসো? আমি ভাবসি ওদেরকে ঠেকাইবা তোমরা।”

“হাহা কী যে বলেন আংকেল। এইগুলা করতে গিয়ে জেলে যাবো নাকি?” ঢাকা থেকে আসা এক বন্ধু বলে উঠলো।

আংকেল খুব নিরাশ হলেন। হায়-হুঁতাশ করা শুরু করলেন। এরপর “এখন ছাগলটাকে খাওয়াবো কী?” বলেই দেখলেন বারান্দায় ছাগলটা নেই। “আমার ছাগল কই?”

“কাঁঠালগাছ নাই, কাঁঠালপাতা খাওয়াইবা কাকে? এইজন্য ছাগল দান করে দিসি।” পলাশ উত্তর দিল।

আংকেল কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “ভালোই করসো। কার কাছে দান করসো?”

“বিদ্যানন্দকে। শুনলাম এই ছাগল দিয়ে ওরা নাকি কয়েকশো মানুষকে খাওয়াবে।”