Sehri Tales 2023

Table of Contents

Day 2 - Candle

ওসি হারুন থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন। টেবিলের উলটা পাশে বসে আছে হিমু। হিমুকে ধরে আনা হয়েছে রমনা পার্ক থেকে। সে রমনা থানার সামনে চা-কফির ফ্লাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আর যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই ফ্রি-তে চা সেধেছে। রোজাদার কিছু লোক এতে রেগে গিয়ে হিমু কে মারতে উদ্যত হলে পুলিশ জলদি সিচুয়েশন সামাল দেয়।

“হিমু” ওসি হারুন বললেন, “তুমি কি বুঝো যে আজকে আর তোমার নিস্তার নাই?”

“জ্বী স্যার বুঝি। একটু পারলে ইফতারের ব্যবস্থা করেন।” হিমু হাসিমুখে বললো।

ওসি হারুনের মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। এখনো আসরের ওয়াক্ত হয় নি, হারামজাদা ইফতার চাচ্ছে কেন? ইচ্ছা করছে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে হিমুকে গালি দিতে কিন্তু রোজা অবস্থায় গালি দিতে চাচ্ছেন না। শয়তানকে তো রমজানে বেঁধে রাখা হয়। হিমু এখনো রাস্তায় কী করছে, ভেবে পান না ওসি। এ তো রোজা-ও রাখে না।

থানায় কারেন্ট নাই অনেক্ষণ হলো। আকাশ মেঘলা। তাই রুমে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। হিমু বললো, “স্যার, আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে রমজানে আসলে শয়তানকে বেঁধে রাখা হয় না?” “না ভাবি নি। কী বলতে চাও সেটা ঝেড়ে কাশো, হিমু। ধানাইপানাই করবা না।”

হিমু বললো, “আসলে রমজানে মানুষকে বেঁধে রাখা হয় যেন সে নিজে শয়তানের কাছে না যেতে পারে। যে খারাপ কাজ করতে চায় সে ঠিকই তা করতে পারে।” ওসি সাহেব ছোটখাটো মানুষ। সে এইসব ধর্মীয় ব্যাপারে নাক গলাতে চান না। এর আগে এসব ব্যাপারে নাক গলাতে গিয়ে তার আগের ওসি নাইক্ষংছড়িতে বদলি হয়েছেন।

হিমু বলতে লাগলো, “আপনি কিন্তু রমজান উপলক্ষে মদের দোকানে ছাড় পাবেন?”

“আসলেই?”

হিমু হাসিমুখে বললো, “জ্বী। তবে আপনি চাইলে আপনার জন্য ফ্রিতে ব্যবস্থা করা যাবে। তবে আমার মনে হয় আপনি রোযা রেখেছেন। রোজা রাখায় ফ্রিতে মদ খাবেন না। টাকা দিয়েই খাবেন।”

এত বড় বেয়াদবি ওসি সাহেবের সহ্য হলো না। তার মন চাচ্ছে হিমুকে ডিম থেরাপি দিবেন। কিন্তু ডিম সিদ্ধ করার জন্য হিটার দরকার। কারেন্ট না থাকায় হিটার চলবে না। হঠাৎ ওসি সাহেবের মাথায় কুবুদ্ধি খেললো। ডিমের জায়গায় মোমবাতি ব্যবহার করলে কেমন হয়? খারাপ না বোধহয়।

ওসি সাহেব হো হো করে হাসতে লাগলেন। হিমু কখনো ভয় পায় না। কিন্তু হঠাৎ এক অজানা ভয় তাকে জেঁকে ধরলো। ওসি সাহেব যেভাবে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে হাসছে সেটা সুবিধার না। তার গা গুলিয়ে আসতে লাগলো।

ওসি হারুন এখনো হেসে যাচ্ছেন।

Day 3 - Middle

১.

জাহাঙ্গীর যখন বাসা থেকে বের হয় তখন তার মা কেবল রান্না চড়িয়েছেন। “খেয়ে বাইর হলে হবি না?” ছেলেকে বললেন তিনি। জাহাঙ্গীর তাড়াহুড়োয় বের হতে হতে বললো, “নাহ, স্বপন স্যার আর্জেন্ট ডাকসে। বাসায় এসে খাবো নি।”

জাহাঙ্গীর স্বপন স্যারের মাইক্রোবাস চালায়। তার এক বন্ধুকে নিয়ে আদালতে যাওয়া লাগবে।

জাহাঙ্গীর আসলে আজকে বাসায়ই থাকতে চেয়েছিল। বাসায় তার অন্তঃস্বত্তা বউ। ১১ মাস আগে বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে সে। এরপর এখানে ওখানে থেকে শেষে আবার মায়ের কাছে ফিরেছে মাস দুয়েক হলো। বউয়ের পেটে বাচ্চা না এলে হয়তো ফিরতো না সে। এ অবস্থায় যত্নআত্তি না করলেই নয়।

জাহাঙ্গীর বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। দরজার উপরে পোস্টার সাঁটানো, “মা ও শিশুর যত্ন নিন।” কাছের হেলথকেয়ার সেন্টার থেকে এই পোস্টার চেয়ে এনেছে সে। তার মা দরজার কাছে চুলায় রান্না করছেন। ভাত আর মুরগির সালুন। তার ছেলে এই রান্না বেশ পছন্দ করে।

২.

নজরুল ইসলামের মেজাজ বেশ খারাপ আজকে। এই নিয়ে চতুর্থবার আদালতে হাজিরা দিতে এসেছেন তিনি। পরবর্তী শুনানির দিন ঘোষণা ছাড়া জজ ব্যাটা কিছুই করে না। সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেম্বার হয়েও এসব পলিটিকাল কেইস ডিসমিস কেন হচ্ছে না বুঝে পান না তিনি। আর মূর্খ এক উকিল চন্দন তার হয়ে কেইস লড়ে, সে-ও কিছু করতে পারে না। নজরুল ইসলাম শক্তমতো একটা গালি দিলেন মনে মনে। আদালত প্রাঙ্গনে গালি দিয়ে আদালত অবমাননা করতে চাচ্ছেন না তিনি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কল এলো তার ফোনে। কাছেধারে নাকি এক সন্দেহভাজন লোককে ধরেছে তার লোকেরা। তাকে কল দিয়ে বলা হলো জলদি যেন এলাকা ত্যাগ করে। নজরুল সাহেব তার বন্ধু স্বপনের মাইক্রোতে উঠলেন। নিজের গাড়িতে যেতে পারতেন কিন্তু এই গাড়িটা ম্যানেজ করা যেন কোন সমস্যা হলে গোপনে চলে যাওয়া যায়। নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু স্বপন, ড্রাইভার জাহাঙ্গীর, সেক্রেটারি সহ পাঁচজন আছে মাইক্রোতে। পিছের আরেকটা গাড়িতে তার উকিল চন্দন আর তার ড্রাইভার আসছে সাথে।

৩.

গাড়ি বেশ দ্রুতগতিতে ছোটানো হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব নিজের এলাকায় ফেরা লাগবে। জাহাঙ্গীর বেশ নার্ভাস বোধ করছে। এইসব পলিটিকাল বিষয় তার ভাল্লাগে না। সে সামান্য ড্রাইভার। তার কাজ স্যারের গাড়ি চালানো। স্যারের বন্ধু আদালতে কী করে সেটা দিয়ে তার কোন কাজ নাই। দুইদিন ধরেই ভাবছে যে আর কাজ করবে না স্বপন স্যারের এখানে। মে মাসটা শেষ হলেই কাজ ছেড়ে দিবে। কয়েকদিন বউয়ের সাথে থাকবে।

গাড়ি ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সামনে পুলিশের চেকপোস্টে গাড়ি দুটো থামানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে কালো রঙের একটা জীপ এসে দাঁড়ালো পাশে। সেখান থেকে বের হয়ে এলেন কালো চশমা পড়া এক লোক। জানালার কাছে এসে বললেন, “আমি মেজর আরিফ। র‍্যাব ১১। আপনারা গাড়িতে উঠেন আমাদের সাথে। একটু সমস্যা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেয়া হবে।”

জাহাঙ্গীরসহ দুই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সাতজন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও জীপে উঠে গেলো সবাই। গাড়িতে উঠার পরই তাদের হাত বেঁধে দেয়া হলো। মাথায় পড়ানো হলো কালো কাপড়। র‍্যাবের ইউজুয়াল প্রসিডিউর।

৪.

লে. কর্নেল তারেক দাঁড়িয়ে আছেন ট্রলারের উপর। তার সামনে সাতজন হাত বাঁধা লোক। এদের প্রত্যেকের মুখে কালো কাপড় ছিলো কিছুক্ষণ আগে। এখন সেটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের সবার চোখে ভয় বুঝাই যাচ্ছে। লে. কর্নেল র‍্যাবের লোক। এই ভয়ের ছাপ তিনি আগেও দেখেছেন। তবে আজকে একটু দয়া বোধ হচ্ছে তার। নজরুল ইসলাম বাদে কারোরই এখানে থাকার কথা না। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এখন তার সামনে সাতজন। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর তো এখানে থাকারই কথা না। শেষ মূহুর্তে নজরুল ইসলাম গাড়ি চেঞ্জ না করলে হয়তো সে এখন নিজের বাসায় থাকতো।

মেজর আরিফকে ডাক দিলেন তিনি। বললেন যে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। রাত থাকতে থাকতে কাজ শেষ করা লাগবে। পরে লোকে জানাজানি হলে সমস্যা হবে। দড়ি আর পলিথিন আনা হয়েছে। সাথে পাটের বস্তা।

মেজর আরিফ শান্তিপ্রিয় মানুষ। আর্মিতে ঢুকার আগে কবিতা লিখতেন তিনি। কবিরা সাধারণত অন্যের দুঃখে ব্যথীত হন। তার উপর জোছনার আলোতে সবাইকে বেশ মলিন লাগছে। এদেরকে কষ্ট দিতে চান না তিনি। ঠিক করলেন এদেরকে মারার আগে ঘুম পাড়িয়ে নিবেন। আশেপাশে কিছু লো র‍্যাংকড সৈনিক আছে। জিজ্ঞেস করলেন কেউ ইঞ্জেকশন পুশ করতে পারে কিনা। কেউ এগিয়ে এলো না। মেজর আরিফ গালির ফোয়ারা ছুটাতে নিয়ে থেমে গেলেন। তার একটা স্ট্যাটাস আছে। এদের সামনে গালি দিয়ে সেই স্ট্যাটাস নামাতে ইচ্ছা করলো না।

মেজর আরিফ ইঞ্জেকশন হাতে এগিয়ে গেলেন নজরুল ইসলামের দিকে। নজরুল ইসলাম বললেন, “কাজটা কিন্তু ভালো করলা না।” মেজর আরিফ সেটা জানেন। তার কিছু করার নেই। উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে। পালন করা লাগবে। নজরুল ইসলামের হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নজরুল ইসলাম ঢলে পড়লেন পাটাতনে। এখন বাকিদের সাথেও একই কাজ করা লাগবে।

জাহাঙ্গীরের কাছে আসতেই সে আস্তে করে বললো, “এক গ্লাস পানি দিবেন? অনেক পিয়াস লাগসে।” মেজর আরিফের মন খারাপ হলো। মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা রাখতে হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরের শেষ ইচ্ছা নিতান্তই শিশুসুলভ। একটু পর যে পানির নিচে থাকবে সে এক গ্লাস পানি খেতে চাওয়ার কোন মানে নেই। ইঞ্জেকশন পুশ করলেন তিনি। জোছনার আলোয় ঘুমিয়ে গেলো সে।

৫.

মেহেরুন বেগম ভাতের থালা নিয়ে বসে আছেন। দুপুরে তার ছেলের ভাত খেতে আসার কথা ছিল। রাত দুটো বেজে গেছে কিন্তু কোন খবর নেই। বিকালে কল দেয়ার পর ওপাশ থেকে “হ্যালো” বলার পরপরই ফোন কেটে যায়। এরপর আর খোঁজ নেই। আল্লাহর কাছে একমাত্র ছেলের বালা-মুসিবত সব দূর করার জন্য দোয়া করতে লাগলেন তিনি।

মেহেরুন বেগম জানেন না যে এতক্ষণে তার ছেলের পেট ছুরি দিয়ে ফুটো করা হয়েছে। এরপর বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয়েছে নদীতে। আগামীকাল আরো ছয়জনের সাথে লাশ ভেসে উঠবে শীতলক্ষার তীরে। পুলিশের রেকর্ডবুকে এ ঘটনাটা হবে পলিটিকাল মার্ডার আর জাহাঙ্গীর হবে একটা অপ্রয়োজনীয় সংঘাতের মাঝে পড়ে যাওয়া কোল্যাটারাল ড্যামেজ।

Day 4 - Shadow

১.

সূর্য ডুবে গেছে অনেক্ষণ হলো। মাওলানা আব্দুল আহাদ নামাযে যাচ্ছেন। তার ডিউটি প্রায় শেষ। ডিউটি বলতে তার কাজ আসলে গোরস্থান সংলগ্ন মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো, আর জানাজার সময় জানাজার নামাজ পড়ানো। এটা ছাড়া তিনি খ্যাপ হিসাবে আরেকটা কাজ করেন। সেটা হচ্ছে দোয়া করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানাজার নামাজের পর মৃত ব্যক্তির কাছের কেউ তাকে কিছু হাদিয়া ধরিয়ে দেয় যেন মৃত ব্যক্তির জন্য তিনি দোয়া করেন। যেহেতু এমনিতে সারাদিনই কোন কাজ থাকে না তাই আহাদ সাহেবও হাদিয়া দেয়া ব্যক্তির আত্মীয়ের কবর জিয়ারত করেন আর খাস দিলে দোয়া করেন।

নামায শেষে আব্দুল আহাদ গেলেন রবিউলের ঘরে। রবিউল কবরস্থানের গোরখোদক। কেউ মারা গেলে তাকে খবর দেয়া হয়। সে কবর খুঁড়ে রাখে। রবিউল থাকে কবরস্থানের পাশেই এক খুপড়িতে। গোরখোদক হিসাবে মানুষ ওকে একটু ভয় পেলেও আসলে সে খুবই স্বাভাবিক মানুষ। তার হাতের রান্না-ও অনেক ভালো। আহাদ সাহেব প্রায়ই রবিউলের সাথে রাতের খাবার খান। তার বাসায় বউ বাচ্চা আছে। রাতে রবিউলের সাথে খান দেখে বউ রাগও করে। কিন্তু রবিউলের হাতের রান্না খেয়ে এই হালকা বকাঝকা পুষিয়ে যায়।

“আজকে কী রান্না করসো রবিউল?”

“এইতো, কলিজা ভুনা। সাথে ফ্যাস্যা আছে কিসু।”

“ভালোই। তোমার রান্না ভালো কিন্তু হাড় ছাড়া খালি মাংস খাইতে আর ভাল্লাগে না।”

“কী আর করার আহাদ ভাই। কচি না হইলে হাড্ডি খাওয়া নিষেধ বুঝো না?”

“বুঝছি। এখন ভাতো বাড়ো। খুধা লাগসে খুব।”

২.

রেহানা বেগমের আজকে মেজাজ অনেক খারাপ। তার স্বামী আজকেও বাইরে থেকে রাতের খাবার খেয়ে এসেছে। এই সপ্তাহে এই নিয়ে তিনদিন তিনি বাইরে খেয়েছেন। ওনার হাতের রান্না এতো খারাপ না যে বাইরে খেয়ে আসতে হবে। দিনের বেলায় বাসায় খেয়ে রাতে বাইরে খাওয়ার কারণে তার আরো বেশি রাগ হয়।

“আজকেও রবিউল শয়তানটার সাথে খাইসেন?”

“শয়তান বলবা না তো। শয়তান অনেক ভারী শব্দ। আল্লাহর সবচেয়ে কাছের বান্দা যখন অবাধ্যতা করসে, তখন আল্লাহ শয়তান নাম…”

“এইসব মৌলানাগিরি তুমি মসজিদে করবা। আমার বাসায় না।” আহাদ সাহেবকে কথা শেষ করতে দিলেন না তার স্ত্রী।

“আচ্ছা, মসজিদে করবো। তোমার মেয়ের খবর কী?”

“জ্বর তো নামে না। এই নিয়া তিনদিন। বললাম, একটা ভালো ডাক্তার দেখাইতে। না উনি হোমিওপ্যাথির ভক্ত।”

“আচ্ছা কানের কাছে এখন ঘ্যানঘ্যান কইরো না। কালকে বিকালে জ্বর না কমলে ডাক্তার দেখাতে যাবো নি। এখন টেনশনে আছি।”

“তা তো থাকবা। গোরস্থানে কাম করে, এই ব্যাটার নাকি অনেক দুশ্চিন্তা।” বলতে বলতে রেহানা বেগম ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। মেয়ের মাথায় পানি ঢালতে হবে। জ্বর কমছে না।

আব্দুল আহাদের অবশ্য দুশ্চিন্তা করার কারণ আছে। রবিউল আজকে আবার লাশ উঠাবে। ধরা পড়লে অনেক ঝামেলা।

লাশ উঠানোর কাহিনী কমবেশি সবাইই আন্দাজ করতে পারার কথা। কবরস্থানগুলায় যে ব্যবসাটা সবচেয়ে রমরমাভাবে করা যায় সেটা হচ্ছে কংকালের ব্যবসা। দেশে প্রচুর মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। সবারই লেখাপড়ার জন্য কঙ্কাল দরকার পড়ে। বেশিরভাগ কঙ্কাল ম্যানেজ করা হয় কবরস্থান থেকে পুরান লাশ চুরি করে। পুরান কবরগুলো সাধারণত বছরে একবার জিয়ারত করা হয়। সেহেতু সহজেই সেখান থেকে কঙ্কাল সরিয়ে নেয়া যায়। একটা কঙ্কাল বেচলে হাজার বিশেক লাভ হয়।

তবে রবিউল আর আহাদ সাহেব পুরান লাশ বা কঙ্কাল চুরি করেন না। তারা চুরি করেন ফ্রেশ লাশ। পুরান কবরের মাটি শক্ত হয়ে যায়। খুড়াখুড়ি করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু নতুন কবরের মাটি নরম থাকে। আর কবর থেকে লাশ বের করে আবার ভরাট করে দিলে কেউ টেরও পায় না। সব লাশ আবার চুরি করা যায় না। ডিফেক্ট ছাড়া লাশ চুরি করতে হয়। হাড়ে ফ্র্যাকচার থাকলে সমস্যা। আবার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কঙ্কাল দরকার। বাচ্চা কারো লাশ কেউ কিনে না। আহাদ সাহেব যাদের জানাজা পড়ান তাদের সব ডিটেলস জানেন বিধায় লাশ নতুন থাকতে থাকতে চুরি করা সহজ।

তাছাড়া নতুন লাশ চুরি করার আরেকটা কারণ আছে। নতুন লাশের মাংস খাওয়া যায়। লাশ চুরি করেই রবিউল লাশ থেকে যতটুক পারে মাংস আলাদা করে ফেলে। এরপর হাড়ে আঙুলে যা লেগে থাকে সেটা এসিড পানিতে দুইদিন ডুবিয়ে রাখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আলাদা করে রাখা মাংস, লিভার এগুলা রবিউল রান্না করে। আহাদ সাহেবও মাঝেমধ্যে তার সাথে যোগ দেন। যারা তাদের থেকে কঙ্কাল কিনে তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের হাড়গোড় পেলেই হয়।

এমনিতেও মাংসের দাম বেশি। ফ্রিতে মাংস খাওয়া আর তার সাথে উপড়ি আয়ের ব্যাপারটা দুইজনের কারোরই খারাপ লাগে না।

৩.

আহাদ সাহেবের মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ডাক্তারের মতে টাইফয়েড। তাও কিছু টেস্ট দেয়া হয়েছে। রেজাল্ট আস্তে একদিন লাগবে। তবে খুব সিরিয়াস কিছু না। প্রোপার রেস্ট আর চিকিৎসা পেলে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। রেহানা বেগম মেয়ের সাথে হাসপাতালেই থাকবেন এই কয়দিন। আব্দুল আহাদের সেই সুযোগ নেই। গোরস্থানে ইমাম একজনই।

আজকে আহাদ সাহেব এক বাচ্চা মেয়ের জানাজা পড়িয়েছেন। এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে মেয়েটা ওয়াশার একটা পাইপের মধ্যে পড়ে যায়। অনেক লম্বা উদ্ধারকার্যের পর লাশ পাওয়া যায় তার। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। জীবনে অনেক ধরনের মৃত্যুই দেখেছেন। এসব তার গায়ে লাগে না আর। তবে নিজের মেয়েও অসুস্থ বলে হয়তো এই ঘটনাটা একটু পীড়া দিচ্ছে তাকে।

রবিউলের বাসায় ভাত খেতে খেতে এসব ভাবছিলেন তখন দেখলেন রবিউল কোদাল নিয়ে রেডি হচ্ছে।

“কই যাও? কালকেই না লাশ তুললা একটা?”

“আজকে বাচ্চাটা মরসে দেখসেন না? কচি মাংস। হাড্ডিও খাওন যাইবো।”

“এই না। দরকার নাই। এমনেই মাংস আছে অনেক। আর বাচ্চার আত্মারে কষ্ট দিও না।”

“আপনি চুপ করেন। নিজে মনে হয় ধোয়া তুলশিপাতা। বাচ্চার লাশ চুরি না করলে সুদ মাংস খাওন ছাড়া উপায় নাই।”

“রবিউল তুমি এই বাচ্চার কবরে হাত দিলে আমি কিন্তু পুলিশে বিচার দিমু।”

“কী বিচার দিবেন? আমি আর আপনে মিল্লা লাশ বেচি এইডা? নাকি মাংস খাই এইডা?” রবিউল কুৎসিতভাবে হাসতে লাগলো।

আব্দুল আহাদ বললেন, “আজকে তোমারে আমি লাশ তুলতে দিমু না, রবিউল।” বলে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। হাত মুষ্টিবদ্ধ।

৪.

রেহানা বেগম মাত্র বাসায় এসেছেন। সারাদিন হাসপাতালে মেয়ের সাথে থেকে ক্লান্ত। তার বোনের বাসা কাছেই। বোনকে বলেছেন ঘন্টা দুয়েক মেয়ের সাথে থাকতে যেন এর মাঝে তিনি বাসায় এসে ফ্রেশ হতে পারেন আর দুচারটা ভাত রেঁধে নিয়ে যেতে পারেন।

ঘরে ঢুকে একটা উঁটকো গন্ধ নাকে লাগলো। ডাইনিং টেবিলে দেখলেন বাজারের ব্যাগ। সেখান থেকে লালবর্ণের তরল বের হয়ে আসছে। রেহানা বেগম ভাবলেন যে তার স্বামী সম্ভবত মাংস কিনে এনেছে। সেখান থেকে গন্ধটা আসছে। আর রক্তও ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসছে। রেহানা বেগম ব্যাগের পেছনটা ধরে ব্যাগটা উলটে ফেললেন। সেখান থেকে আব্দুল আহাদের মাথাটা বের হয়ে টেবিলে গড়িয়ে যেতে লাগলো। তার মুখ দাঁড়ি রক্তমাখা।

রেহানা বেগম চিৎকার করতে লাগলেন। তিনি খেয়াল করলেন না যে তার পেছন দিকে একটা ছায়া কেবল সরে গেল।

Day 5 - Remember

“বাবা মনে আছে আমি সেকেন্ড হওয়ায় সেদিন কী মার-টাই না মেরেছিলে? এরপর তো প্রতিবারই ফার্স্ট না হলে মারলে। কিছু মনে পড়ে?”

বাবা কিছু বলতে পারলো না। উনার শ্বাসকষ্ট উঠেছে। ইনহেলারটা নেয়ার চেষ্টা করছেন পাগলের মতো কিন্তু পারছেন না। তার ছেলে সেটা শক্ত করে ধরে হাতের পিছনে রেখে দিয়েছে।

Day 6 - Astronaut

“তুমি এতো ভালো কেন?”

“কী হয়েছে আবার?”

“তোমার সাথে থাকলে মনে হয় আমার মধ্যে উড়ে বেড়ায় কত কত প্রজাপতি”

“বাটারফ্লাইস? আর কী মনে হয়?”

“মনে হয় আমি এক নভোচারী। ভাসছি যেন মহাকাশে। উড়ে বেড়াই গ্রহ গ্রহান্তরে”

“থাক কবি। আর কাব্য বানানো লাগবে না। ঘুমাও তুমি।”

“তা ঘুমালাম নাহয়। তুমি একটু পাশে বসে থাকো।”

সারিকা চোখ বন্ধ করতেই আমি পাশের বালিশটা নিয়ে তার মুখে চেপে ধরলাম। আর ভাল্লাগে না এসব নাটক করতে। এক্সিডেন্ট করে সে প্যারালাইজড হয়েছে মাস দুয়েক হলো। এতদিনে আমার জীবনটা নরক হয়ে গেছে। প্রেমের বিয়েতে এতো ঝামেলা কে জানতো?

সারিকা হাত দিয়ে বালিশ সরানোর চেষ্টা করছে। কতক্ষণ ধরে রাখা লাগবে বালিশটা? হাতে শক্তি পাচ্ছি না। ত্রিশটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছি একটু আগে।

চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে শুণ্যে ভাসছি যেন। সারিকা আর হাত নাড়াচ্ছে না। সব শেষ বোধহয়। আমিও ঘুমোবো। আর নাহয় উড়ে বেড়াব গ্রহ গ্রহান্তরে। আচ্ছা? সারিকা কি থাকবে আমার সাথে?

Day 7 - Mirror

অফিসে যাওয়ার জন্য বের হতে হতে ফাহাম জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি শরীর খারাপ?” “কই? না তো।” কুহু উত্তর দিলো।

“একটু মনমরা মনমরা লাগে তোমাকে।”

“কিছুই হয় নি। তুমি অফিসে যাও।”

“কিছু না হলে তো ভালোই। শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখাও। স্বাস্থ্য নিয়ে গাফিলতি করা ঠিক না।” বলতে বলতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

শরীর খারাপ না হলেও কুহু একটু সমস্যায় আছে। সে ইদানীং খুব ভয় পায়। ঘটনার শুরু সপ্তাহখানেক আগে।

ফাহাম আর কুহুর প্রেমের বিয়ে। বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে দুইজন। তারপর তারা উঠেছে ফাহামের এক বন্ধুর পুরান ঢাকার বাসায়। বন্ধু আমেরিকায় থাকে তাই ফাহাম আর কুহুকে নিজের বাসায় থাকতে বললো। তারা অবশ্য ভাড়া দিয়েই থাকে। তবে বন্ধুর বাসায় থাকায় একটা সুবিধা হয়েছে, ফার্নিচার কিনতে হয় নি। সবকিছু আগে থেকেই আছে।

সেদিন সকালে কুহু রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটছিলো। এর মধ্যে শুনলো ড্রয়িংরুমের দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। কলিংবেলটা দুইদিন ধরে কাজ করছে না। তাই ঠকঠক শব্দ শুনে কুহু অবাক হলো না। দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কে?” কেউ উত্তর দিলো না। এত বছরের পুরনো দরজায় কোন কীহোল নেই। কুহু হালকা করে দরজা খুলে ফাঁকা দিয়ে দেখলো কেউ নেই।

দরজা লাগাতেই আবার টোকার শব্দ। আবার দরজা ফাঁকা করে দেখলো কেউ নেই। এবার দরজা না লাগাতেই শব্দ হলো। কুহু বুঝতে পারলো যে টোকার শব্দ আসলে দরজা থেকে আসছে না। শব্দটা আসছে দরজার পাশে রাখা বিশাল আয়না থেকে।

আয়নাটা ফাহামের বন্ধুর দাদার আমলের। ড্রয়িংরুমের দরজার পাশে এটা কতদিন ধরে পড়ে আছে কে জানে। যেদিন কুহুরা এ বাসায় উঠেছিল সেদিন আয়নার ফ্রেমটার উপর মোটা ধুলার আস্তর জমে ছিল। মাকড়সার জাল তো ছিলই। ফাহামকে দিয়ে এসব পরিস্কার করিয়েছে কুহু।

আয়না থেকে টোকার শব্দ শুনে কুহু আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মনে হলো একটা ছায়া যেন সরে গেল আয়নার মধ্য থেকে। চোখের ভুল ভেবে কুহু ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। কিন্তু মাথার মধ্যে টোকার শব্দটা ঠিকই গেঁথে আছে। রাতে ফাহামকে বলতেই সে হেসে উড়িয়ে দিলো। “আরেহ এতো পুরানো আয়না। ফ্রেম আবার কাঠের। ঘুনে ধরেছে, দেখো গিয়ে।” অবশ্য এই একটাই ব্যাখ্যা দেয়া যায়।

দুইদিন পর আরো অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো। কুহু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। সেটায় নোমিনি ফাহাম, তাই ফাহামের সাইন দরকার ছিল। ফাহাম সেটা বামহাতে সাইন করে। কুহু কখনো খেয়াল করে নি যে ফাহাম বা’হাতি। সবসময় ডান হাতেই তাকে সবকিছু করতে দেখেছে। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলো না। পরে বলবে ‘এতো বছরের প্রেম এটাও খেয়াল করো নি?’

ব্যাংকে ডকুমেন্ট সাবমিট করার সময় কুহু সিগনেচারটা দেখলো। দেখে কেমন যেন খটকা লাগলো। কী যেন একটা সমস্যা আছে সাইনে কিন্তু বুঝতে পারছে না।

সমস্যাটা সে ধরতে পারলো বাসায় এসে। তারপর থেকে তার গা হিম হয়ে আছে। সিগনেচারটা অবিকল ফাহামের মতোই কিন্তু তার প্রতিবিম্ব। ম লিখেছে সবার আগে আর ফা সবার পরে। আর অক্ষগুলো উলটো। যদি আয়নায় ধরা হয় তাহলে ফাহামের সিগনেচারই হবে।

এরপর থেকে কুহু আর কোন কিছুতে মন বসাতে পারে না। আয়নায় প্রায় প্রতিদিনই হঠাৎ হঠাৎ টোকার শব্দ হয়। কুহু কাছে গেলে একটা ছায়া সরে যায়। অথবা সরে যায় না, কুহু দেখতে পারে না কেবল। সেদিন রাতে সে দেখে ফাহাম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাহাত দিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব ছুঁয়ে দেখছে। সে ফাহামকে ভয় পায় এখন। কিছু না বলে সেখান থেকে সরে গেল। তবে তার মনে হয় ফাহাম জানে ব্যাপারটা।

ডাইনিং টেবিলে ফাহাম আর কুহু বসে ভাত খাচ্ছে। কুহু কোন কথা বলছে না। ফাহাম জিজ্ঞেস করলো, “সব ঠিক আছে?”

কুহু উত্তর দিলো, “হু।”

“তুমি কি আমার উপর রাগ?”

“না তো। এমন মনে হচ্ছে কেন?”

“জানি না। চুপচাপ অনেক।”

“রাগ না। এমনিতে ভালো লাগে না।” কুহু সত্যিটা বলতে পারে না।

“আচ্ছা রাগ হলে রাগ। আসো তোমাকে খাইয়ে দেই।”

ফাহাম বাম হাতে লোকমা তুলে কুহুর মুখের দিকে এগিয়ে দিলো। আয়নাটায় টোকার শব্দ হচ্ছে। ফাহাম যেন শুনেও না শুনলো না। “মুখ খুলো দেখি” সে বললো কুহুকে।

ডাইনিং রুম থেকে আয়নাটা দেখা যায়। কুহুর মনে হচ্ছে ফাহাম আয়নার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। নাকি ভুল দেখছে সে? কুহুর খুব ভয় করছে। তার মুখের দিকে লোকমা এগিয়ে দিতে দিতে ফাহাম মুচকি হাসছে।

Day 9 - Little

বাজারের বাইরে বিশাল গর্ত খোঁড়া হয়েছে। সিপাইরা লাশের পর লাশ নিয়ে গর্ততে ফেলছে। কর্নেল খান গণকবর তদারকি করছেন। এমন সময় তার চোখ আটকে গেল এক ষোড়শীর লাশের দিকে। বুকে গুলি খেয়ে মারা গেছে সে। চোখ দুটো এখনো খোলা - যেন তাকিয়ে রয়েছে কর্নেলের দিকেই।

কর্নেল খান র‍্যাংকের কারণে কিছু দায়িত্ব পালনে বাধ্য। আপার হায়ারার্কির অর্ডারের বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তবে এখন যুদ্ধাবস্থা। যুদ্ধের সময় অনেক কিছু করা সম্ভব।

“ইসকো মেরি ঘার পে লে যাও”, এক সিপাইকে আদেশ দিলেন কর্নেল। তার চোখ চকচক করছে। যুদ্ধের সময় সবকিছুই অনুমোদিত। কেউ বাঁকা চোখে দেখে না। ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো সহজে পূরণ করা যায়।

Day 16 - Enter

১.

রাসেল আর প্রাপ্তির দেখা কাশিমপুর কারাগারে। ষাটজনের বেশি মানুষকে হত্যার দায়ে রাসেল ও তার অনেক কলিগ তখন জেলে। রাসেল অবশ্য কাউকে মারে নি। তবে তার মনে হয় এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।

প্রাপ্তির বাবা-ও তখন কাশিমপুর কারাগারে। তবে তার অভিযোগ খুব গুরুতর না। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা খেয়ে এসেছেন জেলে। আর বছর দশেক পর হলে হয়তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে ঢুকতেন। তবে যাই হোক, এক দেড় বছরের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাবেন বিধায় তার এতো চিন্তা নেই। মোটামুটি হেসে খেলেই তার দিন কাটে জেলে।

একবার ভিজিটিং আওয়ারে রাসেলের চোখ আটকে যায় কয়েদী দেখতে আসা এক সুদর্শনার দিকে। মেয়েটা দেখতে এসেছে মহীউদ্দীন আহমেদকে। রাসেলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। রাসেল একমনে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখাচোখি হয় দুজনের। এসব ক্ষেত্রে চোখ নামিয়ে ফেলাই নিয়ম। কিন্তু দুইজনের কেউই চোখ নামালো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো দুজন। অবশ্য ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ সরিয়ে ফেলে দুজনই। দুজনই পরিবারের লোকের সাথে কথা বলছে। হাতে সময় খুব কম। এর মধ্যে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার মানে নেই।

মেয়েটা চলে যাওয়ার আগে একবার পিছনে ঘুরে তাকালো। সব কয়েদী ফিরে যাচ্ছে নিজেদের সেলে। শুধু রাসেল জায়গা থেকে নড়ছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

রাসেল কবিতা পড়ে না। কবিতা পড়লে হয়তো রবীন্দ্রনাথের লাইন মনে পড়তো - “তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।” সর্বনাশ একজনের হয়েছে বটে। মেয়েটা এক খুনের মামলার আসামীর প্রেমে পড়ে গিয়েছে।

মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে অবশ্য রাসেলের খুব বেগ পেতে হয় নি। মহীউদ্দীন আহমেদ তার সেলমেট।

২.

সিপাহী মইন রুমে পায়চারি করছেন। তার মাথা গরম। তিনি যেখানে কাজ করেন সেখানে তিনদিনের বিশাল অনুষ্ঠান। আজকে সকালে প্রধানমন্ত্রী এসে উদ্বোধন করে গেছেন। আগামীকাল বড় বড় অফিসাররা এসে মিটিং করবেন। সবাই নিশ্চয়ই বেতন বোনাস পাবে। মইনের সেটা সহ্য হচ্ছে না। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে এই অফিসাররা সবাই বহিরাগত।

সিপাহী কাজলকে ডাক দিলেন তিনি।

“কালকে সকালেই সবাই বাইর হওয়া লাগবে।”

“কালকেই করবেন? কালকে না দরবার হলে মিটিং?”

“এইজন্যই তো কালকে করমু। এতজনরে একলগে আর কবে পামু? সবাইরে জাইকা ধরলে দাবি না মাইনা যাইবো কই?”

“সবাইরে জানায়া দিলাম তাইলে।”

“দাও।”

প্রায় আধ ঘন্টা পরে রাসেলের কাছে খবর এলো পরদিনের অভিযানের কথা। সে চাকরিতে জয়েন করেছে যখন, তখন দেশ বেশ বড় একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুই বছর পর সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতা ছাড়লো। নতুন সরকার আসার পর পঞ্চাশদিনও হয় নি।

নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনের সময় রাসেল ভেবেছিল কিছু বোনাস পাবে। কিন্তু সেটা পায় নি। এজন্য সে একটু নাখোশ। তবে তার কিছু কলিগ আরো বেশি নাখোশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় “অপারেশন ডালভাত” নামে একটা প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছিল। সেটার প্রফিট আর কিছু বোনাস পাওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচনের বোনাসের মতো এটারও কোন খোঁজ নেই। এ নিয়ে সবাইই বড়কর্তাদের উপর ক্ষ্যাপা।

আগামীকালের মিটিং-এর সময়েই একটা দফারফা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।

৩.

মহীউদ্দীন আহমেদ দেখলেন রাসেল টলতে টলতে সেলে ঢুকছে। আজকে তার রায় হওয়ার কথা। দেখে মনে হচ্ছে খবর খুব সুবিধার না। তাকে দেখে মায়া হচ্ছে অনেক। জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপার কী?

রাসেল ভেঙ্গে পড়লো। তার ফাঁসির রায় হয়ে গেছে। সে জানতো যে কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। মহীউদ্দীন ভাই বাদে কেউ করে-ও নি। আর কয়দিন পর গলায় দড়ি দিয়ে তাকে ঝুলানো হবে। ব্যাপারটা ভাবতেই অনেক ভয় হচ্ছে। তবে ভয়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে দুঃখ।

মহীউদ্দীন আহমেদ এখন পর্যন্ত তিনবার জামিন পেয়ে বের হওয়ার পরপর জেলগেটেই নতুন মামলা খেয়ে জেলে গিয়েছেন। রাসেলের জন্য ভালোই হয়েছে এটা। প্রায় প্রতি মাসেই সে প্রাপ্তিকে দেখে। প্রাপ্তি তাকে দেখে। দুজনের চোখাচোখি এখন ত্রিশ সেকেন্ডের চেয়ে অনেক বেশি সময় পরে শেষ হয়। এ নিয়ে বছর দুয়েক হলো।

রাসেল দুই হাতে মহিউদ্দীন আহমেদের হাত ধরে বললো, “একটা কথা বলি? শুনবেন?”

“বলো।”

“আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই।”

প্রাপ্তি আর রাসেলের ব্যাপারটা মহিউদ্দীন আহমেদ বেশ ভালো করেই জানেন। কোন সম্পর্ক না থাকলে দুইজন মানুষ চুপচাপ একে অপরের দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। রাসেল ছেলেটা ভালো, তাই এটা নিয়ে তিনি কিছু বলেনও নি। কিন্তু যার দুইদিন পর ফাঁসি হবে তার সাথে কীভাবে মেয়ের বিয়ে দিবেন? তাছাড়া এই দুইজন তো জীবনে কথাও বলে নি!

মহিউদ্দীন সাহেব এমন অন্যায় আবদারে বেশ বিরক্ত হলেন।

৪.

সকাল ৯টা বাজতে বাজতেই সবাই জড়ো হলো পিলখানায়। “বিডিআর সপ্তাহ” এর দ্বিতীয় দিনে দরবার হলে তখন মিটিং চলছে। মিটিং পরিচালনা করছেন খোদ বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। তাছাড়া ডেপুটি পরিচালকও তার সাথে আছেন। আছেন ১৬টা সেক্টরের কমান্ডারগণ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো অনেক অফিসারই আছেন এই বিশেষ দিনে। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিও সহ প্রায় আড়াই হাজার লোকে দরবার হল ভর্তি।

রাসেলের অবশ্য খুব বেশি ধারণা নেই আজকে আসলে কী করা লাগবে। যতদূর জানে সে, আর্মির সাথে অস্ত্রের মুখে একটা চুক্তি করা হবে যাতে করে তাদের পাওনা সব টাকা পরিশোধ করা হয়। তাছাড়া বিডিআর এ আর্মি অফিসারদের দরকার নেই, নিজেদের লোকেরা নিজেদেরকে লিড দিলে ভালো - এ ব্যাপারটা নিয়েও কথা বলা হবে। আরো হাবিজাবি মিলিয়ে একুশ দফা বানানো হয়েছে, এতকিছু জেনে তার কাজ নেই। দিনশেষে পেটে ভাত জুটলেই তার সই।

এক মেজরকে জিম্মি করে পিলখানার অস্ত্রাগার ততক্ষণে লুট করা হয়ে গেছে। লাল সবুজ রুমালে মুখ ঢেকে রাখা সিপাহীরা অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত। দরবারের ভেতরের লোকেরা এখনো কিছু আঁচ করতে পারে নি। অফিসাররা কেউই ভাবে নি যে আজকে তাদের অনেকের জীবনেরই শেষ দিন - আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যাবেন বিডিআর মহাপরিচালক। তাকে দরবার হল থেকে বের করার পরপরই চারজন মিলে ব্রাশ ফায়ার করবে। তার আগেই হত্যা করা হবে ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হককে। একে একে হত্যা করা হবে বাকি ১৫ জন সেক্টর কমান্ডারকেও। মেজর জেনারেল শাকিলের বাসায় গিয়ে লুটপাট করা হবে, তার স্ত্রীকে হত্যা করা হবে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে।

সাড়ে ন’টা নাগাদ দরবারে যাওয়া শুরু করলো সবাই। লাল কাপড়ে মুখ বেধে রাসেল যখন দরবারে ঢুকছে, সে তখনও জানে না যে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের চিত্রপট বদলে যাবে।

৫.

বেলা প্রায় তিনটা। কাজী সাহেব চিৎকার করে বলছেন, “তিনবার বলেন কবুল।” রাসেলও বেশ জোরে উত্তর দেয় “কবুল।” এত এত মানুষের শব্দের মধ্যে তার কবুল শোনা যায় কি যায় না। কাজী সাহেব তাও “আলহামদুলিল্লাহ” বলে বিয়ে শেষ করলেন। রাসেল প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। দুই লেয়ার লোহার শিকের মাঝে প্রায় পাঁচ ফুট দূরত্ব। চেহারা দেখাও বেশ কষ্ট। এর মধ্যে কারাগারে দুইজনের বিয়ে হয়ে গেল।

এমন দৃশ্য কারাগারে কখনো দেখা যায় না। কিন্তু তাতে অন্য কয়েদিদের কিছু যায় আসে না। সবাই নিজের নিজের কাছের মানুষের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। এত অল্প সময়ে সারা সপ্তাহের কথা সারা অনেক ঝামেলা। এর মধ্যে কে বিয়ে করছে কার বাচ্চা হলো এইসব জেনে কাজ নাই।

রাসেলের মা প্রাপ্তির সাথে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। আজীবনই প্রেমের বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। কিন্তু এই অবস্থায় ছেলের একটা ইচ্ছা পূরণ না করতে পারলেই নয়। কী যায় আসে যদি অপরিচিত এক মেয়েকে ঘরের বউ করে রাখতে হয়।

জেলের যে পাশে রাসেল দাঁড়িয়ে আছে, সে পাশেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন মহিউদ্দীন আহমদ - প্রাপ্তির বাবা। তিনি চোয়াল শক্ত করে আছেন। মনে মনে কী ভাবছেন বুঝা যাচ্ছে না। একটা খুব অদ্ভুত সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন তিনি।

Day 21 - Drinks with a Ghost

সাবিহাকে যখন পড়ানো শুরু করি তখন সে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি তখন বিসিএস এ তিনবার অকৃতকার্য হয়ে বয়সের মেয়াদ পার করে বেসরকারি একটা ছোটখাটো চাকরিতে ঢুকেছি। বেতন কম তাই উপড়ি আয়ের জন্য টিউশন খুঁজছিলাম। তখন আমার এক বন্ধু বললো তার ভাইয়ের মেয়েকে যেন পড়াই।

সাবিহার বাবা-মা দুইজনই ছোটবেলায় বাস এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। কোন এক অলৌকিক উপায়ে সে বেঁচে যায়। এরপর থেকে সে থাকে চাচা মানে আমার বন্ধুর কাছে। চাচার নিজের মেয়ে আছে, সাথে সাবিহা। দুইজন একসাথে বড় হয়। ভাইয়ের দিক থেকে বেশ কিছু সম্পত্তি এসেছে, তাই বোঝা মনে করারও কারণ নেই।

দুই বছর হয়ে গেল ওকে পড়াচ্ছি। পড়াতে ভালোই লাগে। তবে এর চেয়ে ভালো লাগে আড্ডা দেয়া। আমি এমনিতে একা মানুষ। বাবা-মা গ্রামে থাকে। বয়স হয়ে গেলো ত্রিশের উপর। পড়ানো শেষে তাই বন্ধুর বাসায় একটু বসি। কিছুক্ষণ আড্ডা দেই। কফি খাই সাবিহার সাথে। ব্যাপারটা একেবারে খারাপ লাগে না।

একদিন সাবিহা আমাকে কফি খাওয়ার সময় বললো, “জানেন আমার তো বিয়ে হয়ে যাবে।”

আমি অবাক মুখে বললাম, “সেকি! এইটুকই তো বয়স হলো। এখন আবার বিয়ে কীসের?”

“কী জানি? আমার মনে হয় আমাকে জলদি ভাগাতে পারলে বাঁচে। অনেকদিন ধরেই তো আছি।”

“না না। এমন ভাবার কিছু নেই। তোমার চাচ্চু আর চাচী তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি কথা বলবো নে।”

সাবিহা কাঁচুমাচু করে বললো, “না থাক, কথা বলা লাগবে না। আমারও মন চায় বিয়ে করে চলে যাই। কী দরকার আরেকজনকে কষ্ট দেয়ার?”

ক্লাস সেভেনের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হলাম। এখন ওকে ঘাটানোর দরকার নেই। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য হাসতে হাসতে বললাম,

“আচ্ছা ঠিকাছে। যদি বিয়ে করে সুখী হতে পারো তাহলে তো ভালোই। আমি কিন্তু বিয়ে না করেই সুখী। ভেবে দেখো…”

সে কিছু না বলে মুচকি হাসলো। আমি বললাম, “তবে ভেবে দেখলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার বিরাট লস হয়ে যাবে?”

“কেন? টিউশন চলে যাবে দেখে?”

“সেটা না। তুমি না থাকলে আমি কফি খাবো কার সাথে?”

“ভূতের সাথে!” বলে সাবিহা কফির খালি মগ দুইটা নিয়ে চলে গেল।

ওর লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়া দেখে বেশ মজা পেলাম। ভাবতেই ভালো লাগছে এই মেয়ের সাথে আমার দুইদিন পর বিয়ে হবে। বয়স কম হলেও মেয়েটা খারাপ না। নিজের মতো করে গড়ে নেয়া যাবে।

তাছাড়া সম্পত্তিও কম পাচ্ছি না। যদিও কিছু আমার বন্ধুর নামে লিখে দিতে হবে সেটা সমস্যা না। এই সময়ে আমার টাকার খুব দরকার।