অলাতচক্র (তারাদাস বন্দোপাধ্যায়) - Review

আমি প্রথম তারানাথ তান্ত্রিক সিরিজের গল্প পড়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদের “আমার প্রিয় ভৌতিক গল্প” নামের বইয়ে। বইয়ের শুরুতে হুমায়ুন আহমেদ কিছু কথা লিখেছিলেন যার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। সেটা হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যে ভূত কিংবা ইন জেনারেল অতিপ্রাকৃত রিলেটেড খুব বেশি মানসম্মত লেখা পাওয়া যায় না। সেবা প্রকাশনীর রহস্য পত্রিকা-তেও একটা টাইম এ সব গল্প প্রেডিক্টেবল হয়ে গেছিল। আর বেশিরভাগ কাহিনী হচ্ছে ‘কারো সাথে দেখা হইসে, পরে দেখে সে অনেকদিন আগে মারা গেসে’ টাইপের।

তো হুমায়ুন আহমেদ তার পছন্দের বেশ কয়েকটা ‘নট টিপিকাল’ স্টোরি একটা বইয়ে কম্পাইল করে পাবলিশ করেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের যত পরিচিত মুখ আছে প্রায় সবার গল্প-ই এইখানে স্থান পায়। নামে “ভৌতিক” থাকলেও, বইটা মূলত “অতিপ্রাকৃত” জনরা-তে যাবে। তো এই বইয়ে যা যা গল্প ছিল, সবগুলাই বেশ মুখরোচক (!!)। তবে দুইটা গল্প আমার তেমন ভাল্লাগে নাই - তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের “ডাইনি” আর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের “তারানাথ তান্ত্রিক”। এই দুইটা গল্প পড়তে গেলেই কেমন জানি জগাখিচুড়ি লাগতো আমার কাছে। তবে তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পটা যতই জাগাখিচুড়ি লাগুক, এইটা শেষ হলে “না জানি তারপর কী হইসে” ভাইব থেকে যেতো। এর অনেকদিন পরে আমি জানতে পারসি যে তারানাথ তান্ত্রিক রীতিমতো একটা সিরিজ আর এটায় অনেকগুলা গল্প আর একটা উপন্যাস আছে। এইটা জানার পর আর লোভ সামলাতে পারি নাই। এরপর যেবার নীলক্ষেত যাই, সেবারই সবগুলা গল্প আর উপন্যাস মিলিয়ে যেই বই সেটা কিনে নিয়ে আসি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিরিজের শুধু দুইটা গল্প বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় নিজে লিখসেন। বাকি সব ওনার ছেলে তারাদাস বন্দোপাধ্যায় কন্টিনিউ করেন। সবগুলা পরার পর আমার মনে হইসে যে তারাদাস তাঁর বাপকে ছাড়িয়ে সিরিজটাকে অনেক উপরে নিয়ে গেছেন এবং এই সিরিজের সবগুলা রাইটিং এর র‍্যাংক করলে, বিভূতি এর নিজের দুইটা শেষ ৫টার মধ্যে থাকবে। যাই হোক, আমার এই পোস্ট পুরো সিরিজ নিয়ে না, বরং সিরিজের যেই উপন্যাস “অলাতচক্র” সেটা নিয়ে। অলাতচক্র উপন্যাসটা শুরু হয় যেই টাইমলাইনে সিরিজের সবগুলা স্টোরি- সেই টাইমলাইনের প্রায় একশ বছর আগের একটা কাহিনী নিয়ে। কাহিনীটা মূলত তারানাথের নিজের দাদার গল্প, যেখানে ‘অমরজীবন’ নামের এক লোক প্রেডিক্ট করে যায় যে সেই ফ্যামিলিতে একটা রেগুলার ইন্টারভালে একজন সন্যাসী ধাঁচের মানুষ জন্ম নিবে। বলা বাহুল্য, তারানাথ তান্ত্রিক হচ্ছে এই পরিবারে সন্ন্যাসব্রত নেয়া মানুষদের মধ্যে একজন।

যাই হোক, এই গল্প বলার পর আমরা আবার ইজ্যুয়াল টাইমলাইনে ফিরে আসি আর তারপর শুরু হয় তারানাথ তান্ত্রিকের নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলা। প্রথমে তারানাথের ছোটবেলার গল্প আর পরে কোন এক জমিদারের প্রাসাদে আতিথ্য পাওয়ার কাহিনী সে গল্পকথক আর তার বন্ধুকে বলে। এই পার্টটুকুতে লেখক বেশ কয়েকবার অতীত আর বর্তমানের মধ্যে আসা-যাওয়া করেন আর প্রতিবার অতীতে গেলে জমিদারের ‘অবস্থা’য় আমরা পরিবর্তন দেখতে পাই। মধ্যবয়সী জমিদার যার এলাকার দুর্গাপূজা পুরো জেলায় বিখ্যাত - ক্ষয়ে আসা জমিদারি - জৌলুস হারানো বৃদ্ধ জমিদার - মরণাপন্ন ব্যক্তি এভাবে বেশ সুন্দর একটা ট্রানজিশন দেখতে পাই আমরা এই অংশে। আর পুরো অংশে কেমন ঘোর লাগা অনুভূতি কাজ করে। আর আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রতিটা অংশে আমরা ‘অমরজীবন’ এর কোন না কোন ক্যামিও দেখতে পাই।

শেষ অংশে আমরা পার্মানেন্টলি বর্তমানে ফেরত আসি। এবার আর তারানাথ তান্ত্রিকের অভিজ্ঞতা না, বরং গল্পকথকের নিজের অভিজ্ঞতা। কোন পাহাড়ি এলাকায় সার্ভে করার জন্য গল্পকথক তার দল নিয়ে যান। তখন তারা বেশ অদ্ভুত সব ঘটনার সম্মুখীন হয়। দলের কেউ ৫ মিনিট হয়েছে ভেবে সারা দিন হারিয়ে ফেলা, অন্যপাশের পাহাড় কাছে চলে আসছে এমন মনে হওয়া, র‍্যান্ডমলি পাহাড়ি মৃত্যুর দেবতার গান বাজা -সহ বেশ কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা আমরা দেখতে পাই। তখন সাহায্য চাওয়ার জন্য কথকের তারানাথের কথা মনে পড়ে। পুরো সিরিজজুড়েই এই কথাটা বারবার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল যে তারানাথ তান্ত্রিক এর আদতে কোন ক্ষমতা না-ও থাকতে পারে। বরং এমন হতে পারে যে সে আসলে শুধু গল্প বানায়, বাস্তবে এমন কিছুই ঘটে নি। উপন্যাসের এই অংশে এসে আমরা আসলে দেখতে পাই যে তারানাথের আদৌ কোন শক্তি আছে নাকি। আর তারপর লেখকের দেখা হয় ‘মৃত্যুঞ্জয়’ বা এতক্ষণ যেই ‘অমরজীবন’ এর কথা বললাম তার সাথে।
এরপর কথক তার সার্ভে শেষে ফিরে আসে, আর দেখা করে তারানাথের সাথে। কিছু কথোপকথনের পর উপন্যাসের ইতি ঘটে।

পুরো উপন্যাসটা পড়ার সময় আমি একধরণের ঘোরের মধ্যে থাকি। আমার মনে হয় না এইরকম একটা অভিজ্ঞতা আমি অন্য কোন লেখা পড়তে নিয়ে পাইসিলাম। জমিদারের সাথে তারানাথের ইন্টার‍্যাকশনগুলায় আমি আনন্দ থেকে শুরু করে মারাত্মক দুঃখবোধ - সবগুলা ইমোশনের মধ্য দিয়ে যাই যেটা এই ধরণের জনরা-তে বেশ রেয়ার। আর উপন্যাসটা যখন শেষ হয় আমি তখন একটা শুণ্যতা ফিল করতেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন এই সিরিজটা কখনো শেষ না হলে ভালো হতো (আনফরচুনেটলি এটাই ছিল সিরিজের শেষ লিখা)।

এখন পর্যন্ত আমি অগুণতি লেখা পড়সি - এই উপন্যাসটার মতো ঘোর লাগা অনুভূতি আর শুধু একটা লেখা দিতে পারসিল (সেটা ছিল হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর একটা উপন্যাসের অনুবাদ)। উপন্যাসটা শেষ হওয়ার পর আমার প্রথম কাজ ছিল পরদিন আবার রিরিড দেয়া। যদিও কাহিনী সব জানতাম, তাও আরেকবার সেই ঘোরটা আমি ফিল করসি। মেবি এটা আমার প্যারানর্মাল জনরা-র প্রতি খুব বেশি ইন্টারেস্টের কারণে। তবে লেখককে আমি পূর্ণ ক্রেডিট দিব।

এটা পড়ার পর আমার মনে হইসে যে তারাদাস বন্দোপাধ্যায় কোন কারণে তার বাপের ছায়ায় পরে গেছে আর তার প্রাপ্য প্রশংসা সাহিত্যমহল থেকে পায় নাই। তবে পরে খেয়াল হলো যে সে নিজেই বাপের ছায়া থেকে বের হতে চায় নাই। প্রথম দুইটা গল্প (যেগুলা বিভূতিভূষণ নিজে লিখসিলেন) আর তারাদাসের নিজের লিখাগুলার মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল। এবং কাউকে পড়তে দিলে মনে হবে সবগুলা একই লোক লিখসে। হয়তো তারাদাস তার বাবার রাইটিং স্টাইল চেঞ্জ করতে চায় নাই, হয়তো তার সেই সামর্থ্য-ই ছিল না। তবে যাই হোক, ‘অলাতচক্র’ এর মতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের প্যারানর্মাল জনরা কে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, এইটুক এটলিস্ট আমার বিশ্বাস।

Rating: 9.5/10 (১০-ই দিতে মন চাইসিল, প্লটহোলগুলার জন্য দেয়া গেল না। তবে আগের সব স্টোরি বাদ দিয়ে শুধু অলাতচক্র কনসিডার করলে এই প্লটহোলগুলা মাথায় আসবে না)