আপনি কীসের বিবলিওফাইল?
তখন মাত্র কলেজে উঠেছি। নতুন বন্ধুবান্ধব জোটানোর কার্যক্রম চলছে। মাঝে মনে হলো একটু এক্সট্রোভার্ট হওয়া দরকার। যেহেতু বাস্তবে কথা বলতে একটু অকওয়ার্ড লাগে, ভাবলাম অনলাইনে এক্সট্রোভার্ট হই। তো অনলাইনে সোশালাইজিং করা এত সহজ না। এসব ক্ষেত্রে হয় মাইরালা গ্রুপে ক্রিঞ্জ পোস্ট করা লাগে নাহলে কোন উইব গ্রুপে ‘আরা আরা’ লিখে কমেন্ট করা লাগে। আমি যেহেতু উইব না এবং তখনকার সময় একটু এজি মিমলর্ড টাইপ ছিলাম, তাই আমি মধ্যপন্থা অনুসরণ করলাম। জয়েন দিলাম একটি খুব জনপ্রিয় শিশুসাহিত্য সিরিজ সংক্রান্ত রোলপ্লে গ্রুপে।
জয়েন দিয়ে দেখি এ এক অবাক জায়গা। চিনে না জানে না একজন আরেকজনকে অনলাইনে বিয়ে করে ফেলতেসে কারণ ওদের দুইজনের ক্যারেক্টার বইয়ে বিয়ে করে। খুবই সুন্দর ব্যাপারস্যাপার। ভাবলুম সোশালাইজ করে করে সোশালিস্ট হয়ে যাই একেবারে। আমিও বইয়ের এক অখ্যাত ক্যারেক্টার সেজে পোস্ট কমেন্ট করি। মানুষের সাথে পরিচিত হই। ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড হই। বইয়ের চরিত্রটা বিবাহিত হলে হয়তো তিন কবুলও বলে ফেলতাম।
যাই হোক, কলেজে দুইটা কুইজে মারা খাওয়ার পর রোলপ্লের ভ্রম কাটলো। হাবিজাবি বাদ দিয়ে সিরিজ দেখায় মন দিলাম। মুভিখোর গ্রুপে অপছন্দের শো এর প্রশংসা করলে গালাগালি করে আসি। তাছাড়া মিমলর্ড হিসাবে ইন্টারনেট কমিউনিটি তে সময় দেয়া লাগে। সেই সুবাদে আরো কিছু মানুষ ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড হলো। এর কয়েকদিন পর মনে হলো যে বেশি সোশালাইজিং করে ফেলসি। আনফ্রেন্ড করা দরকার ফ্রেন্ডলিস্টে যারা আছে। শুরু হলো আনফ্রেন্ড অ্যাডভেঞ্চার।
অ্যাডভেঞ্চার বলছি কারণ কাকে আনফ্রেন্ড করবো এটা ভেবে উঠতে সময় লাগে। যদি ছেলে হয় তাহলে তেমন কঠিন কিছু না। মেয়ে হলে একটু যাচাই বাছাই করে বাদ দেই। যেহেতু মোস্তফা জব্বারের মতো “বাংলা হরফে নাম না হলেই বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে” টাইপের রুল আমার ছিল না, তাই একটু বায়াসনেস এসে পড়েছিল। একদিন এক মেয়ের আইডিতে এসে থমকে গেলাম। মনে হলো একে চিনি আমি। আবার মনে হলো চিনি না। “চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা” মোমেন্ট একটা। সিদ্ধান্ত না নিতে পেরে শেষে ভাবলাম ম্যাসেজেই জিজ্ঞেস করি যে চিনি নাকি।
মেয়েটা রিপ্লাই দিলো। বললো, “চিনতে পারি। বিবলিওফাইল নাকি?” আমি বই কম পড়ি নাই জীবনে। বঙ্কিম, শরৎ, মানিক থেকে শুরু করে জাফর ইকবাল, সবই পড়া হইসে। জাতে উঠার জন্য ইংরেজি বইও পড়সি ভালোই। ভাবলাম বলে দেই যে হ্যাঁ।
সে খুব খুশি হয়ে গেল। বললো, “তাই নাকি? ক্রনিকলস অব নার্নিয়া পড়সেন?” টিন ফ্যান্টাসি হিসাবে হ্যারি পটারই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। নার্নিয়া পড়ার কোন ইচ্ছাই কখনো জাগে নাই। বললাম, “নাহ পড়া হয় নাই।” সে বললো, “টোয়াইলাইট সাগা?” আমি মনে মনে বললাম আমাকে বিষ খাওয়াইলেও এই জিনিস পড়বো না। এরপর টেক্সটে লিখলাম, “না। পড়বো দেখি।” এরপর সে আমাকে বললো, “হাংগার গেমস তো পড়সেন এটলিস্ট?” আমি “খাইসে আমাকে” বলে চ্যাটে লিখলাম, “এইটাও পড়ি নাই।” সে খুব রেগে গেল। বললো, “ওই মিয়া কিছুই তো পড়েন নাই। কীসের বিবলিওফাইল?”
আমি আশাহত হলাম। আসলেই তো! কী পড়লাম জীবনে? দুঃখে আনফ্রেন্ড অ্যাডভেঞ্চার বাদ দিলাম। নতুন আইডি খুলে সেই আইডি বন্ধ করে দিলাম ট্রমা ভুলার জন্য। যারা বেঙ্গল আর বাতিঘরে ছবি তুলে বইপ্রেমী হওয়ার ভান ধরে তাদের জানা উচিত, হাংগার গেমস আর টোয়াইলাইটের মতো টিন ফ্যান্টাসি না পড়ে প্রকৃত বইপ্রেমী হওয়া সম্ভব না।