একটি অর্থনৈতিক রম্য

তখন দেশে কলেরার প্রকোপ। এক অর্থনীতিবিদকে চিনতাম। তিনি তখন ঢাকায় অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করছেন। তার পরিবার থাকতো গ্রামে। তাকে কয়েকবার বললাম পরিবারের সবাইকে ঢাকায় নিয়ে আসতে, কিন্তু রাজি হন নি। এতে নাকি রিসার্চে অসুবিধা হয়।

কয়েকদিন পর টেলিগ্রাম এলো, তার দুই ছেলে একই দিনে কলেরায় মারা গেছে। শুনে অর্থনীতিবিদ বললেন, “হুম।” এরপর গ্রাফে কীসব আঁকিবুকি শুরু করলেন। ভাবলাম শোকে কাতর হয়ে গেছে। একটু সময় দেই, কোপিং করছেন হয়তো। আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে উনি ছেলেদের জানাজা তেও গেলেন না। ভাবলাম সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার চেষ্টা।

এর দুইদিন পর জানলাম যে তার বউও মারা গেছে। অর্থনীতিবিদ বললেন, “হুম।” এরপর জিডিপি, জিএনপি, ট্রিকল ডাউন কী সব শব্দ আউড়াতে লাগলেন। ভাবলাম এ বুঝি শোকে পাগল হয়ে গেছে। আমি তাকে বললাম মন ভালো করার জন্য কোথাও ঘুরে আসি। তিনি তা নাকচ করে বিদ্ঘুটে সব ইকুয়েশন এর অন্তরজ বের করা শুরু করলেন।

তার বাবা আরো আগেই গত হয়েছেন। পরদিন শুনলাম কলেরা তে মা-ও মারা গেলেন। অর্থনীতিবিদ বললেন, “আহারে।” আমি ভাবলাম, তাও উন্নতি হচ্ছে। একটু পরেই বোধহয় কাঁদবেন। অর্থনীতিবিদ না কেঁদে শেয়ারবাজারের সব দরদাম যাচাই করছেন আর কী সব কাগজে টুকছেন। রিসার্চ করে করে ব্যাটার আবেগ সব মরে গেছে নাকি ভাবছি।

দুইদিন পর টেলিগ্রাম এলো তার ভাইও মারা গেছেন। আমি ভাবলাম একে জানিয়ে লাভ নেই - দেখবো একটি দেশে সর্বোচ্চ কয়টা উন্নয়ন প্রজেক্ট থাকলে তা দেউলিয়া হবে না এরকম অংক কষা শুরু করবে। কিন্তু তাকে জানাতেই দেখলাম হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। টানা তিনদিন কিছু মুখে দিল না। আমরা রুমে ঢুকলেই দেখি “আমার ভাই মারা গেছে” বলে মাটিতে শুয়ে বিলাপ করছে। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম যে বাকি সবাই মরল, তখন কিছু বললেন না। ভাই মরার পর এত শোক কীভাবে আসছে?

অর্থনীতিবিদ বললেন, “যখন দুই ছেলে মারা গেল, তখন ভাবলাম ব্যয় কমে গেছে। তাছাড়া ছেলে গেলে আবার ছেলে আসবে। যখন বউ মারা গেল তখন ভাবলাম অন্তত মাথাপিছু আয়টা বাড়লো। তাছাড়া বউ গেলে আবার বউ আসবে। যখন মা মারা গেল তখন দেখলাম যে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।” আমি জানতে চাইলাম, “তাহলে ভাই মরলে তো মাথাপিছু আয় আরো বাড়ার কথা। এত কাঁদলেন কেন?” অর্থনীতিবিদ রেগে গেলেন। বললেন, “আরে মূর্খ! মাথাপিছু আয় এত বেড়ে গেলে কি দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে না?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এজন্যই কাঁদছিলেন?” উনি লজ্জিত মুখে বললেন, “না মানে আয়টাও তো ভাইই করতো…”