কমরেড ব্রোকেনের প্রথম প্রেম

“তখন নতুন নতুন কৈশোরে পা রাখা। বাসা থেকে আমার লাগাম ছেড়ে দিয়েছে কারণ ছেলে মানুষের ব্যাটা মানুষ হওয়া লাগবে। লাগাম ছাড়ার পর আমার দৌড় স্কুল পার হয়ে গিয়ে পৌঁছালো টঙের দোকানে। টঙে বসে শুরুতে জীবনের আলাপ, তারপর রাজনীতির আলাপ করি।
টঙে বসে যেই ছেলে রাজনীতির আলাপ করে, তার জীবন এইটুকুতেই থেমে থাকে না। জীবনে নাটকীয়তা আনার জন্য তখন প্রয়োজন পড়ে নারীচরিত্রের। এই চরিত্র টঙের বন্ধুদের মতো সাইড ক্যারেক্টার হবে না। এই চরিত্র হবে গল্পের মেইন ক্যারেক্টার, যার একটা সামান্য বাক্যও ডিসাইড করতে পারে প্রোটাগনিস্টের জীবন কি পারফেক্ট রম-কম হবে নাকি দেবদাসের মতো ট্র্যাজিক কিছু একটা হয়ে যাবে।

আমি প্রেমে পড়লাম।

গার্লস কলেজের মেইনগেটের উল্টা পাশের টঙে বসে বিড়ি খাওয়া তখন হ্যাডমের ব্যাপার। আমার হ্যাডম ছিল না, তাই আমি কেবল চা খেতাম। সাহস একটু বাড়লে চুলে স্পাইক করে কানে হেডফোন গুঁজে লিরিক্স না বুঝে হেভি মেটাল শোনা হতো। একদিন এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে বিড়ি হাতে নিলাম - লাইটার জ্বালাবো, দেখি নীল ইউনিফর্ম পরে কলেজের গেট দিয়ে বের হচ্ছে এক নীলপরী। বিড়ি পড়ে গেলো হাত থেকে। নীলপরীর সামনে বিড়ি হাতে নেওয়ার মতো অপরাধ করায় নিজেকে শাপশাপান্ত করতে লাগলাম। সেই সাথে মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম যেন নীলপরী আমাকে বিড়ি হাতে দেখে না থাকে।

আগে দেশের চিন্তায় ঘুম হতো না, এখন নীলপরীর চিন্তায় ঘুম হয় না। ঘুমালে স্বপ্নে দেখি নীলপরী আর আমি নীল আকাশের নীচে ঘাসের উপর শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে মেঘ দেখতে খরগোশের মত নাকি বিড়ালের মতো তা নিয়ে তর্ক করি। নীলপরী খিলখিল করে হাসতে থাকে। তার হাসি শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হই, খুশিতে বুক চিনচিন করে। বুকের ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়। এরপর সারারাত জেগে থাকি।
সকাল হলে দৌড় দেই কলেজে, কলেজের পর টঙের দোকানে। সেখানে অপেক্ষা করি কখন নীলপরী বের হবে, আমি দূর থেকে একনজর তাকে দেখব। মাঝেমধ্যে মনে হয় তাকে একটা আইসক্রিম কিনে দেই। সে আইসক্রিম খাবে, আইসক্রিম গলে গলে তার হাত বেয়ে পড়বে। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। তারপর ভাবি, থাক। দূর থেকে দেখাই হয়তো ভালো। মনে মনে হেমন্ত কুমারকে স্মরণ করি, “আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি।”

তখন ফেসবুক চলে, কিন্তু এর চল অতটা নাই। তাও নীলপরীর ফেসবুক একাউন্ট খুঁজা শুরু করলাম। জনাকয়েকের কাছে ধরনা ধরে শেষে নীলপরীর একাউন্ট পেলাম। এই প্রথম তার নাম জানতে পারলাম। নীলপরী হয়ে গেল ‘সপ্তর্ষি’। আমি হয়ে গেলাম মাঝসমুদ্রে খেঁই হারানো এক নাবিক, সপ্তর্ষি যাকে পথ দেখায়। তবে পথ এর চেয়ে সপ্তর্ষিকে দেখাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে গেল। ততদিনে বখাটেদের মতো টঙের দোকানে বসে তাকে দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। এর চেয়ে রাতে ঘুমানোর আগে একবার সপ্তর্ষির ছবি দেখি। মাঝেমধ্যে সে তার প্রোফাইলকে ডায়েরি ভেবে সারাদিন কী হয়েছে তা লিখে, সাথে হয়তো একটা ছবি দেয়। আমি সেগুলা মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার পড়ি। লাইক দেই না ভুলেও, কারণ লাইক দিলে সে জেনে যাবে। আবার মনে হয় জানবে তো একদিন এমনিতেও, এত লুকানোর কী আছে! আমি পড়ি দোটানায়।

সপ্তর্ষি বিড়াল পছন্দ করতো। তার বাসায় দুইটা বিড়াল। একটার নাম টিকটিকি, আরেকটার নাম আরশোলা। আমি তার নামের চয়েস দেখে মুগ্ধ হই। এইরকম নাম যে রাখতে পারে, তার সারল্য অবশ্যই তুলনাবিহীন! টিকটিকি আর আরশোলার খোঁজ নিতে নিতে আমিও হয়ে গেলাম বিড়ালপ্রেমী। রাস্তায় বিড়াল দেখলে মিঁও করে ডাক দেই। কলেজের ক্যান্টিনে একটা বিড়াল আসে। তার জন্য স্পেশাল দশ টাকার পরোটা কিনি। এরপর একটু একটু করে খাওয়াই। মন ভালো থাকলে চিকেন ফ্রাই দেই। কোনদিন সপ্তর্ষিকে পরিচয় দিতে পারলে বিড়ালপ্রেমী হিসাবে পরিচয় দিব।

কয়দিন পর দেখি নীলপরী একদিন লালদলের পোস্ট শেয়ার দিল। টঙের দোকানের রাজনীতি ফেসবুক হয়ে এসে পড়লো আমার হাতের কাছে। প্রলেতারিয়াত, বুর্জোয়া এইসব বুঝি না, কিন্তু বুঝলাম যে প্রথমটা ভালো পরেরটা খারাপ। প্রথমে ভাবলাম এইটুক জানা-ই বোধহয় যথেষ্ট। পরে দেখি সে প্রায়ই এইসব শেয়ার দিতে লাগলো। কোন জায়গায় শ্রমিকশোষণ হয়, কেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদেরকে কষ্টই দিবে কেবল এইসব জানতে লাগলাম। যেই আমি কোষবিভাজন বুঝতে তিন কোচিংয়ে দৌঁড়াতাম, সেই আমি শ্রেণীবিভাজন বুঝলাম। বিড়ালগুলাকে দেখলে মিঁও এর জায়গায় বলি ‘লাল সালাম’। নিজের বিড়াল পাললে হয়তো নাম দিতাম কমরেড বিড়াল।

একদিন রাতে সাহস গেল বেড়ে। সপ্তর্ষিকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে ঘুম দিলাম। আসলে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আসলো না। সে কি আমার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করবে? করলে কি আমি ‘লাল সালাম’ বলে কথা শুরু করবো? যদি না করে তখন কী হবে? চিন্তায় আর চোখের পাতা এক হলো না। সূর্য উঠার আগে তিনবার চেক করলাম ফোন, কোন রেস্পন্স পেলাম না। ভাবলাম দেখে নাই, পরদিন দেখবে।

সকালে একটু বাইরে বের হলাম। সপ্তর্ষিকে দেখলাম এক লোকের বাইকের পিছনে বসে ঘুরছে। তা ঘুরতেই পারে। বাইকআরোহী যে কেউ হতে পারে, এত সন্দেহ করার কিছু নেই। কিন্তু বিকালে দেখলাম ফেসবুকে একটু চিজি ক্যাপশন দিয়ে আরোহীর সাথে সে পোস্ট দিল। যে দামী রেস্টুরেন্টে চেক ইন করলো তা থেকে বুঝলাম, আর যাই হোক এই ছেলে প্রলেতারিয়াত না। আমি জানলাম বিপ্লব ভালোবাসলেও সপ্তর্ষি বিপ্লবী ভালোবাসে না। মেজাজ একটু বিগড়ে গেল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কমেন্ট করে বসলাম “পুঁজিবাদী বুর্জোয়া”। একটু পর মাথা ঠান্ডা হলে ভাবলাম যে কমেন্টটা ডিলিট করে দিব। কিন্তু পোস্ট খুঁজে পেলাম না। তারপর খেয়াল করলাম যে আইডিও খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তার ব্লকলিস্টে!

পরদিন আবার টঙে গেলাম। দেখি সেই বুর্জোয়া বয়ফ্রেন্ড গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। নীলপরী কলেজ থেকে বের হয়েই বাইকে উঠে পড়ে। এই কষ্ট আর নিতে পারলাম না। তার জন্য যা যা করতাম সবই বাদ দিলাম। টঙে আর যাই না। বিড়াল একটা পালবো ভেবেছিলাম, এখন বিড়াল দেখতেও পারি না। বিড়ালপ্রীতি সব গেল, আমি হয়ে গেলাম ডগ পার্সন।”

গল্প শেষ করে কমরেড ব্রোকেন একটা রুটি নিয়ে পাশে বসা কুকুরকে খাওয়াতে লাগলেন। কুকুরটাকে উনি ডাকেন টিকটিকি। আমি ভাবলাম, ভালোই। ব্যাটা আমার গল্প আমাকে শুনিয়ে বিরাট গল্পকার হয়ে গেল।

নোট: এই গল্পের সকল চরিত্র, স্থান, কাল আমার কল্পনাপ্রসূত। বাস্তব জীবনের কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং নিতান্তই কাকতালীয়।