মাহে রমজানের শুভেচ্ছা (২০২৩)
সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। মুসাফির দাঁড়িয়ে আছে এক বাড়ির সামনে। দরজায় টোকা দিবে নাকি বুঝতে পারছে না সে। রমজান মাস, তাই ইস্তাম্বুলের রাস্তাঘাট সব খালি। খলিফার নির্দেশে কাজের সময় এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন সবাই পরিবারের সাথে ইফতার করতে পারে।
মুসাফির অনেক ক্ষুধার্থ। অনেক রাস্তা ভ্রমণ করে সে এতদূর এসেছে। এখন কোথাও একটা আশ্রয় না পেলেই নয়। উপায় না পেয়ে সে দরজায় টোকা দিলো। মাঝবয়সী এক লোক দরজা খুললেন। মুসাফিরকে দেখে তার মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মুসাফিরের হাত ধোয়ার জন্য এল গরম পানি। সাথে পরিস্কার সাদা তোয়ালে। এত আপ্যায়নে অবাক হলো সে। ক্লান্ত থাকায় কোন কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
কিছুক্ষণের মধ্যে ইফতারের সময় হয়ে এলো। টেবিল ভর্তি হয়ে গেল সুস্বাদু খাবারে। আপ্যায়ক মুসাফিরকে খাবার খেতে বললেন। নিজেও ইফতার করা শুরু করলেন। ক্ষুধার্ত মুসাফির কোন আপত্তি করলো না।
ইফতারের পর তাদের কথাবার্তা হলো। কোথা থেকে এসেছে, পরিচয় কী এসব। ধন্যবাদ জানিয়ে মুসাফির বিদায় নিতে যাবে। এমন সময় আপ্যায়ক ডাক দিলেন, “দাঁড়ান। আপনাকে কিছু উপহার দিতে চাই।” মুসাফির বুঝলো না কী উপহার আছে তার জন্য। আপ্যায়ক থলেভর্তি অর্থ এগিয়ে দিলেন, “এটা আপনার জন্য।” মুসাফির অবাক হলো, “আমার জন্য কেন?”
আপ্যায়ক বললেন, “বাহ! আপনি আমার বাসায় এসেছেন, আমার সাথে এক টেবিলে খাবার খেয়েছেন। রমজানে এই যে আপনি আমাকে এতো নেকী এনে দিলেন, আপনাকে ছোট একটা উপহার না দিলে তো অন্যায় হয়ে যায়।”
টাকার থলে নিয়ে অবাক মুসাফির আবার শুরু করলো তার পথচলা। সে জানে না যে রমজান উপলক্ষে মুসলিমরা যা যা করে সে তুলনায় এই আতিথেয়তা কিছুই না।
ওসমানীয় খিলাফতকালে রোজার মাস ছিল উৎসবের মাস। দুইদিন পর ঈদ, এ ব্যাপারটা তো আছেই, পুরো মাসই আল্লাহর রহমত লাভের বিশেষ সুযোগ। এ সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগানোর লোভ কেউ সামলাতে পারতো না। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে খোদ সুলতান পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন আল্লাহকে খুশি করার জন্য। রমজান মাসে কাজের সময়সূচি পরিবর্তন আর আতিথেয়তার কথা তো বলাই হলো। মানুষের দানখয়রাত করার অভ্যাসও জেঁকে বসতো।
সদকাহ করার একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল অন্যের হালখাতা ক্লিয়ার করা। দেখা যেত কেউ একজন দোকানে গিয়ে দোকানিকে বললো তার হালখাতায় র্যান্ডম একটা পৃষ্ঠা খুলতে। এরপর সে পৃষ্ঠায় যত টাকা বাকি সেটা সে পরিশোধ করে দিলো। কার বাকি সে শোধ করেছে সেটা নিজেও জানে না। যার বাকি পরিশোধ করা হয়েছে সে-ও জানে না এটা কে করেছে। একবারে যেন “যে ব্যক্তি এমনভাবে দান করে যাতে তার বাম হাত না জানতে পারে ডান হাত কী করছে” এর মতো। আল্লাহর আরশের ছায়া পাওয়ার জন্য তাদের এতো আকাঙ্ক্ষা। (বুখারি - ১৪২৩)
বাচ্চাকাচ্চারা দলবেঁধে রাস্তায় খেলতো। মসজিদ সাজানো হতো কারুকার্য দিয়ে। ধর্মীয় একটা ব্যাপার যত আনন্দের বানানো যেত ততোটাই আনন্দদায়ক বানানোর ব্যবস্থা করতো ওসমানীয়রা।
এখন আর রমজান ওইভাবে পালন করা হয় না কোথাও। হয়তো সরকারীভাবে কিছু পরিবর্তন আসে, কিন্তু আগের মতো উৎসবমুখর কিছু আর হয় না। তবে কিছু জিনিস তবু থেকে যায়। থাকে কিছু ভৌগোলিক ফ্লেভার। পরিবারের সবাই একসাথে ইফতার খাওয়া, প্রতিবেশিদেরকে ইফতার করানো, তারাবীর শেষ সারিতে বাচ্চাদের দুষ্টুমি - এগুলা তো সব জায়গারই গল্প।
সবাইকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা। আল্লাহ আমাদেরকেও রমজানের সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়ার তৌফিক দিন। আমিন!