র‍্যান্ডম স্মৃতিচারণ

বাঙালি জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্কিল হচ্ছে বাজারে দামাদামি করা। একটু সতর্ক না হলে ২০টাকার সবজি ৪০টাকায় ধরিয়ে দিবে আর আপনিও “জিতসি” ভেবে খুশিমনে বাসায় ফিরবেন। তো আমি যাতে বড় হয়ে এই ধরণের সমস্যায় না পরি সেজন্য ট্রেনিং হিসাবে প্রায় ছুটির দিনে আমাকে বাপের সাথে বাজারে যেতে হত। অ্যাপ্রেন্টিসশিপ যাকে বলে আরকি।

তো যেই বয়সের কথা বলতেসি, তখন আমার বাবা সিলেটে চাকরি করেন, আমি, আম্মু আর ছোট বোন ঢাকায় থাকি। দুই সপ্তাহ পরপর বাবা ঢাকায় আসতো দুইদিন এর জন্য। তো বাজার থেকে কী কী কেনা লাগবে সেটার বিশাল লিস্ট জমতো আর বাবা আমাকে সাথে নিয়ে যেত কিনতে। বাজারে যাওয়া বেশ বোরিং ব্যাপার, দুইজন লোক লম্বা সময় ধরে দামাদামি করতেসে এরপর “হুর মিয়া আপনার মটরের বিচি তো ছোট” বলে মাঝপথে ট্রেডিং বন্ধ করে দেয়া খুবই নরমাল জিনিস। এইজন্য পারতপক্ষে আমি বাজারে যেতে চাইতাম না। এইজন্য আমাকে অনেক লোভ দেখানো হইতো - “আজকে বাজারের পর যেই টাকা থাকবে ওইটা তোমার” টাইপের আরকি (পরে অবশ্য দেখা যাইতো যে টাকা বাঁচসে দুই টাকা)।

টাকা পয়সার লোভ বাদেও আরেকটা জিনিসের জন্য মাঝেমধ্যে বাজারে যাওয়ায় আগ্রহ বোধ করতাম। সাধারণত কাঁচাবাজারে বাবা আমাকে নিতো না। প্রথমে কিছু সবজি কিনে এরপর মুদির দোকানে সদাইয়ের লিস্ট ধরায় দিতো। ওরা সবকিছু রেডি করতো, আমি সবজির ব্যাগ নিয়ে বসে থাকতাম ওইখানে আর বাবা কাঁচাবাজার থেকে মাছ-মাংস কিনে আনতো। তো মুদির দোকানের ওরা তো বিশাল অর্ডার পেয়ে খুশিমনে কাজে লেগে পরতো। দোকানের সামনে চালে, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ অনেকগুলা বস্তা সাজানো থাকতো। সবার ব্যস্ততার সুযোগে আমি ডালের বস্তা থেকে একটু একটু করে ডাল নিয়ে চালের বস্তায় মিশাতাম। এই ব্যাপারটায় একটা পৈশাচিক আনন্দ ছিল। একটা লোক দোকান থেকে চাল কিনসে, এরপর রান্না করার পর দেখে ভাতের মধ্যে ডাল। সে মুদির দোকানিকে গালি দিতেসে ইচ্ছামতো - এই পুরা ব্যাপারটা ভাবতেই একটা আশ্চর্য শিহরণ কাজ করতো। আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে এই ব্যাপারটা আমি সরাসরি দেখার সুযোগ কখনো পাই নাই। তবে থট এক্সপেরিমেন্ট হিসাবে যে এটা আমার শিশুমনে বেশ আনন্দ দিতো সেটা না বললেও চলে। একবার পেঁয়াজের বস্তায় রসুন রাখার কথা মনে হইসিল, পরে খেয়াল করলাম যে মানুষ বেছে বেছে পেঁয়াজ নেয়। এইজন্য রসুন নেয়ার চান্স নাই। তাই প্ল্যান বাদ দিতে হইসিল।

বাবা কাঁচাবাজার থেকে ফেরত এসে মুদির দোকানদারের থেকে হিসাব নিতো সব। এরপর জিজ্ঞেস করতো আমি দুষ্টুমি করি নাকি। ব্যাটা সুন্দরভাবে বলতো যে আমি খুবই শান্তশিষ্ট আর কোন গেঞ্জাম করি নাই। এত বড় আকাজ করেও ধরা না খাওয়ায় আমি মনে মনে হাসতাম। আর হাসতাম এই দোকানদার কোন র‍্যান্ডম কাস্টমারের কাছে গালি খাবে এইটা ভেবে। এইটা লিখার সময়ও মুচকি মুচকি হাসতেছি। ছোটবেলা থেকেই ইভিল থটস থাকার কারণেই হয়তো আর দামাদামি শিখতে পারি নাই। দেশে থাকতে আসলেই ২০টাকার সবজি ৪০টাকা দিয়ে কিনার পর ‘জিতসি’ ভেবে বাসায় যেতাম।

যাই হোক, এখনো মাঝেমধ্যে মন চায় যে এমন কিছু করি। কিন্তু নানা কারণে সম্ভব না। প্রথমত আমি যেখানে আছি সেখানে সুপারশপ ছাড়া মুদিবাজার করার আর কোন উপায় নাই। দ্বিতীয়ত, এখন আর এইসব করার বয়স নাই। বাপের সাথে বাজারে যাই না তাও অনেকদিন হইসে। সময় খালি সামনেই আগায়। এই ব্যাপারটা অনেক প্রবলেম্যাটিক…